ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪

মাছও নেই, ঈদের আনন্দও নেই

মাছও নেই, ঈদের আনন্দও নেই

ছবি সংগৃহীত

সারাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ মে ২০২২ | ১৩:২৬ | আপডেট: ০২ মে ২০২২ | ১৫:০০

তবে ভিন্ন চিত্র ভোলার জেলেপল্লিতে। ঈদের আনন্দ নেই সেখানকার জেলে পরিবারের মাঝে। মার্চ-এপ্রিলে জেলার মেঘনা-তেঁতুলিয়ায় ১৯০ কিলোমিটারজুড়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। এরপর নদীতে ইলিশ না থাকায় তাদের ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। 

ধার-দেনা করে আবারও সঙ্কটে পড়ার শঙ্কায় দিশেহারা জেলেরা। ঈদের দিন ঘরে মিষ্টান্ন তো দূরের কথা শিশুদের গায়ে নতুন জামা উঠবে কিনা তা নিয়েই যত দুঃশ্চিন্তা। দিন-রাত নদীতে জাল ফেলে সবে দু’চারটি ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। তাতে খরচের টাকাও উঠছে না।

একদিকে এনজিও, অন্যদিকে মহাজনের দাদনের টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে জেলেদের। এর ওপর রয়েছে সংসারের খরচ। কোনও কোনও জেলে পরিবারে দু’বেলা দু’মুঠো ভাতও জুটছে না। সবমিলিয়ে জেলে পরিবারগুলো এখন চরম বিপাকে রয়েছে। 
এসময় মাছ বিক্রি করে জেলেপল্লিতে ঈদ উৎসবের আমেজ থাকার কথা। সেখানে চরম সঙ্কটের মুখে অভাব অনটনে জীবন-যাপন করছেন জেলেরা। চলছে নীরব হাহাকার।

ভোলার মেঘনা পাড়ের ইলিশা, তুলাতুলি, নাছির মাঝি, ভোলার খালসহ প্রায় অর্ধশতাধিক ছোট বড় ঘাটে এখন নেই আগের মতো কর্মচাঞ্চল্য। আড়তদারদের মাছের বাক্সগুলো খাঁ খাঁ করছে। আড়তে বসে অলস সময় পার করছেন তারা। দু’এক ঝুড়ি মাছ ঘাটে আনা হলেও আগের মতো নেই হাঁকডাক। জেলেদের পাশপাশি আড়তদারেরাও রয়েছেন বিপাকে।

কথা হয় ভোলা সদর উপজেলার কোরারহাট জেলেপল্লির জেলে শিশু ফারিয়ার সঙ্গে। জানায়, এলাকার অন্য সহপাঠীরা ঈদের নতুন জামা কিনেছে। তাই বাবার কাছে আবদার করে সে। কিন্তু ফরিদ মাঝি মেয়েকে আশ্বাস দেন নদীতে মাছ পেলে, তবেই তার নতুন জামা কিনবেন।

ইলিশা মাছ ঘাটের জেলে মো. রফিজল মাঝি  বলেন, ‘রাত ১২টার দিকে আমরা সাতজন জেলে নদীতে ইলিশ শিকারে গিয়েছিলাম। সকাল ৬টা পর্যন্ত নদীতে মাছ ধরি। তবে বড় সাইজের ইলিশের দেখা না মিলেও ১০/১২ ডা জাটকা পেয়েছি। ঘাটে বিক্রি করে ১৮০০ টাকা পাই। কিন্তু ট্রলারের তেল ও আমাদের খাবার খরচ বাবদই ব্যয় হয়েছে ২৭০০ টাকা।’

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার পরে আশা করেছিলাম নদীতে অনেক মাছ ধরতে পারব। কিন্তু গতরাত থেকে সকাল পর্যন্ত জাল ফেলে আশানুরূপ ইলিশ পাইনি।’

একইভাবে তুলাতুলী মাছ ঘাটের রহিম মাঝি বলেন, ‘অভিযানের সময় আমরা নদীতে যাই নাই। মাছও ধরতে পারি নাই। আশায় আছিলাম, অভিযান শেষে নদীতে যাইয়া মাছ ধইরা বিক্রি করে আগের দেনা পরিশোধ করতে পারমু। কিন্তু নদীত এখন মাছের যেই অবস্থা, তাতে দেনার দায়ে দেশ ছাইড়া পলাইতে হইব।’

আবু মাঝি বলেন, ‘দুই দিন পরে ঈদ অভিযান শেষে অনেক আশা লইয়া গাঙ্গে গেছিলাম কয়ডা মাছ ধরমু। তা বিক্রি কইরা বাড়িত পোলাইনের লইগা নতুন জামা আর সেমাই কিনমু। কিন্তু নদীতে যাইতে ট্রলারের তেলসহ খরচ হইছে ৭০০-৮০০ টাকা। মাছ বিক্রি করেছি ১১০০ টাকার। এই অবস্থায় কোনও কূল-কিনারা পাইতাছি না।’

ধনিয়া তুলাতুলী মাছ ঘাটের আড়তদার মো. নাছিম বলেন, ‘নদীতে আশানুরূপ ইলিশ না থাকায় আমাদের ব্যস্ততা কম। অভিযান শেষে জেলেরা নদীতে গিয়ে শুধু ইলিশ নয়, অন্য প্রজাতির মাছের দেখাও পাইনি। দুই মাসের নিষেধাজ্ঞার পর তেমন কোনো মাছ ঘাটে আসেনি। এ কারণে ঘাটে বেচাকেনা নাই বললেই চলে। এখন দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি মোকামে কি মাছ পাঠাব। ঈদ উপলক্ষে মোকাম থেকে মাছের জন্য অনেক চাপ দিচ্ছে।‘

জেলা মৎস্যজীবী সমিতি সভাপতি মো. এরশাদ ফরাজি বলেন, ‘এই অভিযানের সময় আমাদের জেলেদের সরকারের পক্ষে চার মাসে ১৬০ কেজি চাল প্রণোদনা হিসেবে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুই মাসে চাল ৫০ থেকে ৬০ কেজি করে দিয়েছে। অভিযান শেষ হওয়ার পরও বাকি দুই মাসের চাল জেলেরা এখনও পাননি।’

তিনি বলেন, ‘গতকাল রাত থেকে জেলেরা নদীতে নামছেন। কিন্তু মাছ কম থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। এই দুঃসময়ে তাদের পুনর্বাসন না করা হলে জীবনযাপন খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। জেলেদের বাকি দুই মাসের চাল যাতে দ্রুত দেয়া হয়, এটাই আমাদের দাবি।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম আজহারুল ইসলাম জানান, মার্চ-এপ্রিল ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়ার ১৯০ কিলোমিটারসহ দেশে ৬টি অভয়াশ্রমের মিঠা পানিতে ইলিশ বিচরণ করে। এসময়টা ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে অভয়াশ্রমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। বিচরণ শেষে সাগর মোহনায় চলে যায় তারা। এ কারণে সাগর ও সাগর মোহনায় ইলিশের পরিমাণ বেশি রয়েছে। ফলে বর্তমান সময়টায় মেঘনা-তেঁতুলিয়ায় ইলিশের পরিমাণ কম পাওয়া যাচ্ছে। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলে পুনরায় মেঘনা-তেঁতুলিয়ায় ইলিশের দেখা মিলবে।

তিনি বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার এসময়টায় নিবন্ধিত জেলেদের জন্য ৪ মাসে ১৬০ কেজি চাল বরাদ্দ হইছে। যার মধ্যে ২ কিস্তির চাল ইতোমধ্যে ঈদের আগে বিতরণ করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যানরা ভিজিডি, প্রধানমন্ত্রীর ঈদসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় বাকি ২ কিস্তি চাল বিতরণে বিলম্ব হচ্ছে। ঈদের পরপরই বাকি চাল জেলেদের মাঝে বিতরণ করা হবে।’

জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইলিশের অভয়াশ্রমে মার্চ-এপ্রিল মাছ ধরা বন্ধ ছিল। এই দুই মাসে ভোলায় ৪০০টি অভিযানে ৮৯৭ জন জেলেকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে। বাকিদের ২৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

উল্লেখ্য, দ্বীপ জেলা ভোলায় প্রায় দুই লাখ জেলে নদীতে মাছ ধরে জীবীকা নির্বাহ করেন। এর মধ্যে নিবন্ধিত জেলে আছেন ১ লাখ ৩৯ হাজার। মৎস্য বিভাগের মতে, দেশে ইলিশের চাহিদার প্রায় ২৫ ভাগ ভোলা থেকেই উৎপাদন করা হয়।

সম্পর্কিত

আরও পড়ুন

×