ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪

বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিচারকাজ অব্যাহত থাকবে

সমকাল ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৬:৩০ | আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৭:২৮

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, চলতি মেয়াদে মামলাজট কমানোই মূল চ্যালেঞ্জ সরকারের। এ ছাড়া ই-জুডিশিয়ারি গঠন এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে বিচারব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা হবে। তিনি আরও বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় তাদের বিচারকাজ অব্যাহত থাকবে।

গুলশান কার্যালয়ে সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন আনিসুল হক। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ওয়াকিল আহমেদ হিরন 

সমকাল: টানা তৃতীয়বারের মতো দায়িত্ব পেলেন। আপনার মূল চ্যালেঞ্জ কী হবে? 

আনিসুল হক: দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন বিপুলসংখ্যক মামলাজট কমানোই আমার প্রধান চ্যালেঞ্জ। কারণ, মানুষ দ্রুত ন্যায়বিচার চায়। এতে দেরি হলে সেটা আর ন্যায়বিচার থাকে না। আমাদের এই দায়িত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছেন। মামলাজট নিরসনে যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তাই করা হবে। 

সমকাল: এই চ্যালেঞ্জ পূরণে কী পদক্ষেপ নেবেন?  

আনিসুল হক: দেখুন, ব্রিটিশ আমলের কিছু আইনের কারণে দেশে বিশালসংখ্যক দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হচ্ছে। বর্তমানে ৩৮ থেকে ৪০ লাখ মামলার জট সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৪ সালে প্রথম আইনমন্ত্রী হওয়ার পর মামলাজট কমানোর কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। এবারও তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করা হবে। তা করতে গিয়ে প্রথমত অধস্তন আদালতে বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেব। বিশ্বব্যাপী মামলাজট নিরসনের সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত পদক্ষেপ হচ্ছে, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর)। ছোটখাটো অভিযোগের জন্য আদালতে না গিয়ে এডিআরের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে আদালতের বাইরে সেসব মামলা নিষ্পত্তির সুযোগ আছে। প্রতিবছর এর মাধ্যমে অনেক মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। এতে মামলাজট নিরসনে তা বিরাট ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া দেশে অনেক আপসযোগ্য ফৌজদারি মামলা আদালতে ঝুলে আছে। এসব মামলা যদি আপস হয়ে যায়, তাহলে সেখানেই আমরা পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করছি। মামলাজট দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আরেকটা বড় পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে, সেটা হচ্ছে ই-জুডিশিয়ারি প্রজেক্ট। এই প্রকল্প আমরা শিগগির শুরু করতে পারব। এটা চালু হলে দুটি জিনিস হবে। একটা হচ্ছে– অনেক মামলা আছে, আর থাকার প্রয়োজন নেই– সেগুলো শনাক্ত করে নিষ্পত্তি করা হবে। পাশাপাশি দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি আবার সংশোধন করা হবে এবং সেটা বাংলায় অনুবাদ করার চেষ্টা করছি। এ ছাড়া জাতীয় আইনগত প্রদান সহায়তা সংস্থাকে আরও কার্যকর করার পদক্ষেপও নেওয়া হবে। সবমিলিয়ে আগামী পাঁচ বছর আমরা এসব দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেব। 

সমকাল: বিএনপির অভিযোগ– নির্বাচন ও আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে তাদের নেতাকর্মীকে নির্বাচনের আগে আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের পরে কোনো সাজা হয়নি। তাদের অভিযোগ কতটা সত্য? 

আনিসুল হক: ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে সারাদেশে সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর ওপর অমানুষিক ও বিভীষিকাময় নির্যাতন চালায়। এসব নির্যাতন ও হামলার ঘটনায় কিছু মামলা হলেও সে সময় তদন্ত হয়নি। পরে অনেক মামলা তারা প্রত্যাহারও করে নিয়েছে। আবার ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রও চালানো হয়। এই মামলায়ও সঠিক বিচার কার্যক্রম চলেনি। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এসব মামলার তদন্ত শুরু হয়। এ ছাড়া বিএনপি-জামায়াত নির্বাচন বানচাল করার জন্য ২০১৩-২০১৫ সালে বাসে আগুন দিয়ে নিরীহ বাসযাত্রীদের পুড়িয়েছে, রেললাইন উঠিয়েছে এবং বিভিন্ন নাশকতা করেছে। সুষ্ঠু অভিযোগের ভিত্তিতে এসব মামলারও তদন্ত হয়েছে। মামলাগুলোর চার্জশিট ও সাক্ষ্য গ্রহণ চলাকালে নির্বাচনের সময় এসে গেছে। এমন না যে নির্বাচন না করার জন্য তাদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা হয়েছে এবং অপরাধের কারণে তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এখানে আদালত যে সাজা দিয়েছে, সেখানে সরকারের কিছু করার নেই। কাজেই তাদের এ অভিযোগে মোটেই সঠিক নয়। এখন প্রশ্ন উঠছে– নির্বাচনের পর কেন কোনো মামলায় তাদের সাজা হয়নি? আমি বলছি– এসব মামলার বিচারকাজ আবারও শুরু হবে। কারণ, দ্বাদশ নির্বাচনের সময় পাঁচ শতাধিক বিচারককে নির্বাচন কমিশনে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তারা আবারও ফিরে এসেছেন। সে কারণে কিছু দেরি হয়েছে। এখন আবারও মামলার বিচার কার্যক্রম চালু হবে।

সমকাল: দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে। কোনোভাবেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না বা টাকা ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। এখানে প্রতিবন্ধকতা কোথায়? 

আনিসুল হক: এটা দুর্নীতি দমন কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। তারপরও বলছি, একটা মামলার বিচার শেষ হয়ে রায় না পাওয়া পর্যন্ত টাকা ফেরত আনার ব্যবস্থা করা খুবই কঠিন। রায় হলেই আমরা মনে করি, টাকা ফেরত আনার প্রক্রিয়া চালু হলো। তবে টাকাগুলো যে দেশে আছে তারাও আমাদের সঙ্গে খুব একটা সহযোগিতা করে না। এমনকি আইনগত কারণে সহজেই তারা টাকা ফেরত দিতে চায় না। জটিলতাটা আসলে এখানেই।  

সমকাল: সরকার বলছে, বিএনপি নেতা তারেক রহমানকে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে এবং তাঁর সাজা কার্যকর করা হবে। এটা কতটা সম্ভব? 

আনিসুল হক: শুধু তারেক রহমান নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পলাতক আসামিসহ সাজাপ্রাপ্ত সবাইকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। করোনার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবার অন্তত তাদের ফিরিয়ে আনতে পারব।  

সমকাল: নির্বাচন বাতিল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?

আনিসুল হক: বিএনপির এই অসাংবিধানিক, অনৈতিক দাবি ও কর্মসূচি দেশের জনগণ আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের এই দাবি ও কর্মসূচির প্রতি জনগণের কোনো সমর্থনও নেই। কাজেই যে দাবির প্রতি  জনগণের সমর্থন নেই, তা বিবেচনার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। 

সমকাল: দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। নতুন সরকার বিষয়টিকে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ মনে করে কী?

আনিসুল হক: ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। এটা এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে। আমার মনে হয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা– এগুলোই মানবাধিকার। এ দেশের মানুষের এখন তিন বেলা পেট ভরে খাওয়ার সামর্থ্য হয়েছে। তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থাও করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরেকটি কথা হচ্ছে, আমাদের যথেষ্ট বাকস্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রয়েছে। পৃথিবীর ১৯৩টি দেশের মধ্যে খুব কম দেশেই এরকম বাকস্বাধীনতা বা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রয়েছে। দেশের ৫০টির বেশি টিভি চ্যানেলের টক শোতে প্রতিদিন সরকারের সমালোচনা করা হয়। এটাকেই বলে মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা। 

সমকাল: বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশের দাবি– দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠ হয়নি। 

আনিসুল হক: তাদের এই দাবির কোনো সত্যতা আছে বলে মনে করি না। দেশের জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করে থাকে। তারা যদি সে নির্বাচনে সন্তুষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে অন্য কোনো দেশ বা দল কী বলল তাতে কিছু আসে-যায় না। আর তাদের এই অযৌক্তিক কথার গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। 

সমকাল: যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধে সরকারের পদক্ষেপ কতদূর?  

আনিসুল হক: জামায়াতের বিচারের জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। আমরা চেষ্টা করব আইনটা সংশোধন করে সংগঠন হিসেবে জামায়াতকেও বিচারের আওতায় আনার জন্য। 

সমকাল: সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত নিয়ে আপনি বলেছেন– এই তদন্ত ৫০ বছর ধরে চললেও অপেক্ষা করতে হবে। এটা কি ব্যর্থতা মোচনের জন্য বললেন?  

আনিসুল হক: দেখুন, সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তকারী সংস্থা দীর্ঘদিন ধরেই বিষয়টির সুরাহা করতে পারছে না। এখন তদন্তে সুরাহা না হলে এমন কোনো কাজ কী তাদের করা উচিত হবে, যাতে নির্দোষ ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে চার্জশিট দিতে হয়? এখানে একটা হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার রহস্য উদ্ঘাটন করে বের করা প্রয়োজন। সরকার সেটা চেষ্টা করে যাচ্ছে। যে প্রকৃত অপরাধী তাকেই ধরা উচিত। এই মামলার তদন্তে যতক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত দোষী শনাক্ত না হবে– ততক্ষণ পর্যন্ত এই তদন্ত চলাটাই শ্রেয়। এ কারণেই আমি আপেক্ষিকভাবে বলেছি– দোষীদের ধরার জন্য যত সময় লাগুক, আমরা ধরব। এই কথাকে আপনারা মনে করেছেন যে, ৫০ বছর লাগবে। এটা সঠিক নয়। 

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। 

আনিসুল হক: সমকালকেও ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন

×